ছয়দফা ও বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা - সামরিক শাসন ও স্বাধিকার আন্দোলন (১৯৫৮ - ১৯৬৯) | | NCTB BOOK

পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন । বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্য ছিল, ছয় দফা দাবি আদায়ের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে বৈষম্যের হাত থেকে রক্ষা করা । মূলত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ অবসানের পর পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানি সরকারের চরম অবহেলা ও সীমাহীন বৈষম্যের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু সোচ্চার হন । ১৯৬৬ সালের ৫-৬ই ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধীদলীয় নেতারা একটি সম্মেলনের আহ্বান করেন । আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু লাহোের পৌঁছান । সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ‘ছয় দফা প্রস্তাব পেশ করলে সম্মেলনের নেতৃবৃন্দ তা প্রত্যাখ্যান করেন। বঙ্গবন্ধু সম্মেলন বর্জন করেন এবং ছয় দফা সাংবাদিকদের সামনে প্রকাশ করে ঢাকায় ফিরে আসেন। ২১শে ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর নামে 'আমাদের বাঁচার দাবি : ছয় দফা কর্মসূচি' শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়।

দফাগুলো ছিল নিম্নরূপ :

  • লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে সংবিধান রচনা করে পাকিস্তানকে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করতে হবে । এটি হবে সংসদীয় পদ্ধতির যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা। প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভা হবে সার্বভৌম ।
  • ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়। অন্যান্য বিষয় থাকবে প্রাদেশিক সরকারের হাতে ।
  • দেশের দুই অঞ্চলের জন্য সহজে বিনিময়যোগ্য দুটি মুদ্রা চালু থাকবে । মুদ্রা লেনদেনের হিসাব রাখার জন্য দুই অঞ্চলের জন্য দুইটি স্বতন্ত্র স্টেট ব্যাংক থাকবে। মুদ্রা ও ব্যাংক পরিচালনার ক্ষমতা থাকবে প্রাদেশিক সরকারের হাতে । অথবা, দুই অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকবে, তবে সংবিধানে এমন ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে মুদ্রা ও মূলধন পাচার হতে না পারে। একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে এবং দুইটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে ।
  •  সকল প্রকার কর ও শুল্ক ধার্য ও আদারের ক্ষমতা থাকবে প্রাদেশিক সরকারের হাতে। আদায়কৃত অর্থের একটি নির্দিষ্ট অংশ ফেডারেল তহবিলে জমা হবে। এ দ্বারা ফেডারেল সরকার ব্যয় নির্বাহ করবে।  
  • বৈদেশিক মুদ্রা ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রদেশগুলোর হাতে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে। বৈদেশিক বাণিজ্য ও সাহায্যের ব্যাপারে প্রদেশগুলো যুক্তিযুক্ত হারে ফেডারেল সরকারের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা মিটাৰে ।
  • আঞ্চলিক সংহতি ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য প্রদেশগুলো নিজস্ব মিলিশিয়া বা আধা সামরিক বাহিনী গঠন ও পরিচালনা করতে পারবে।

 

ছয় দফার গুরুত্ব:
১৮-২০ শে মার্চ, ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে ছয় দফা গৃহীত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু ছয় দফার পক্ষে জনমত পড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন স্থানে ২০ মার্চ থেকে ৮ মে পর্যন্ত ৩২ টি জনসভায় বক্তব্য দেন। তিনি ছয় দফাকে 'আমাদের বাঁচার দাবি আখ্যায়িত করেন। ফলে ছয় দফার পক্ষে দ্রুত ব্যাপক জনমত গড়ে ও আইয়ুব সরকার তাতে আতঙ্কিত হয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ধরপাকড় শুরু করে। আইয়ুব খান এ সময় পূর্ব পাকিস্তানে এসে বিভিন্ন জনসভায় ছয় দফাকে রাষ্ট্রদ্রোহী ও পাকিস্তানের অখতার প্রতি হুমকি বলে আখ্যা দেন। দিনে দিনে ছয় দফার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেলে আইয়ুব সরকার বঙ্গবন্ধুকে ১৯৬৬ সালের ৯ই মে গ্রেফতার করে। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে ৭ই জুন দেশব্যাপী হরতাল পালিত হয়। হরতালের সময় মিছিলে পুলিশের গুলিতে অনেক লোক প্রাণ হারায়। এ ঘটনার প্রতিবাদে ৮ই জুন প্রাদেশিক পরিষদে বিরোধী দল ওয়াকআউট করে । ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুকে ঐতিহাসিক আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত করে ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু করে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের মুখে সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ছয় দফা কর্মসূচি ছিল নির্বাচনের মূল ইশতেহার। এ নির্বাচনে ছয় দফার পক্ষে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জিত হয়। তথাপি ছয় দফা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি । ১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় । দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে ।

Content added By
Promotion